সাংবাদিক একে এম ফখরুল আলম বাপ্পী চৌধুরী’র মতে সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার কি ?

* সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার কি ? What is Journalist and Journalism? একেএম ফখরুল আলম বাপ্পী চৌধুরী : শব্দগত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার প্রতিশব্দ জার্নালিষ্ট (journalist) ও জার্নালিজম (journalism)। Ôjournal’ অর্থ কোন কিছু প্রকাশ করা। Ôism’ অর্থ চর্চা বা অনুশীলন। তাহলে সাংবাদিকতা (Journalism) হচ্ছে কোন তথ্য প্রকাশ করার লক্ষ্যে চর্চা বা অনুশীলন করা। এসব শব্দ ‘জার্নাল’ থেকে এসেছে। এ জন্য যিনি জার্নাল বিশারদ আমরা তাকেই এক কথায় সাংবাদিক বলতে পারি। সাধারণত সাংবাদিক বলতে যিনি সংবাদ লিখেন তাকেই বুঝায়। যিনি সংবাদ লিখেন একমাত্র তিনিই সাংবাদিক নন। বরং সংবাদপত্রে বা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে এ পেশার সাথে জড়িত প্রত্যেককেই সাংবাদিক বলা যায়। সাংবাদিকতা একটি ব্যাপক ও বহুমাত্রিক অর্থে ব্যবহৃত শব্দ। অনেকেই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সাংবাদিকতাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ভিন্ন মত পার্থক্য রয়েছে। সাংবাদিকতার কোন সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য মানদন্ড বা কাঠামোয় সীমাবদ্ধ করা সম্ভব নয়। নানামাত্রিক সীমাবদ্ধতার কারণে সার্বজনীনভাবে একে সংজ্ঞায়িত করা একটি দুঃসাধ্য প্রয়াস। হ্যাঁ প্রিয় পাঠক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ চলুন নিজের মতো করে সংজ্ঞায়িত করি- বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক আইন কানুন, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যবলির প্রতিদিনের একই চিত্র যা যুগে যুগে শতাব্দী অববাহিকা চলমান তা তুলে ধরা সাংবাদিকতা নয়, বিজ্ঞাপন। রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক নিয়মের- অনিয়ম, আইনের- বেআইন, প্রকৃতির প্রতিদিনের একই চিত্রের বাইরে গুপ্ত বা সাম্প্রতিক অনাকাঙ্খিত ঘটে যাওয়া ঘটনার সঠিক তথ্য প্রমাণসহ বিস্তারিত বিশ্লেষণ হুবহু বিভিন্ন গণমাধ্যমে অবহিত করাকে সাংবাদিকতা বলে। এক কথায়, “অগোচরে পরে থাকা তথ্যকে সকলের গোচরে যে নিয়ে আসে তাকে সাংবাদিক বলে”। সাংবাদিকতা হলো মানব সমাজ, জীববৈচিত্র, প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য, রাষ্ট্রের গতিবিধি বর্ণনার এক প্রকৌশলী। যেমন: সূর্য পূর্ব দিক থেকে উঠে পশ্চিমে অস্ত যায় এটা গণমাধ্যমকে অবহিত করা সাংবাদিকতা নয়। এটা প্রকৃতির নিয়ম। প্রশাসনিক কর্মকর্তা যখন রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব পালন করে এটা কখনো সংবাদ বা খবর হতে পারে না, এটা বিজ্ঞাপন। কারণ রাষ্ট্র তাঁদেরকে স্ব স্ব পদে নিয়োগ দিয়েছে অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য। যদি কোন প্রশাসনিক দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, বা নিয়মের অনিয়ম করে তখন তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করাই সাংবাদিকতা। বাংলাদেশের সংবাদপত্র আইন ১৯৭৪ এ পেশাদার সাংবাদিকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, পেশাদার সাংবাদিক হচ্ছেন একজন সার্বক্ষণিক সাংবাদিক যিনি একটি সংবাদপত্র বা এদসংক্রান্ত কোন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত... যার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সম্পাদক, লিডার রাইটার, বার্তা সম্পাদক, সহ সম্পাদক, ফিচার রাইটার, প্রতিবেদক, সংবাদ দাতা, অনুলিপি পরীক্ষক, কার্টুনিস্ট, সংবাদ আলোকচিত্র, ক্যালিগ্রাফিস্ট ও প্রæফ রিডার। সর্বোপরি আমরা বলতে পারি, ঐ ব্যক্তিই সাংবাদিক যিনি সংবাদ সংগ্রহ করবেন এবং তা সাধারণের মাঝে বিলি করবেন। সেটা হতে পারে সাম্প্রতিক কোন ঘটনা বা পুরোনো। তবে, সাংবাদিকেরা সংবাদগুলো একে অপরের সাথে আদানপ্রদান করে থাকেন। যেমন, একজন আন্তর্জাতিক বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ করে তা তার সহকর্মীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন। রেডিও, টিভি বা পত্রিকার পেশাদার সাংবাদিক ছাড়াও বর্তমান সময়ে নতুন এক সাংবাদিকতার উদ্ভব হয়েছে। যেখানে দেশের কোন একজন সাধারণ নাগরিক সাংবাদিকের ভূমিকা পালন করে থাকে। কোন ঘটনার সাক্ষী হয়ে বা ঘটনার অংশগ্রহণ করে যখন একজন ব্যক্তি ঘটনার বর্ণনা সংবাদ আকারে কোন মাধ্যমে ( হতে পারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা বøগ) প্রকাশ করে থাকেন তখন তা নাগরিক সাংবাদিকতা। এক্ষেত্রে সংবাদটি লিখিত বা ভিডিও, উভয় রকমই হতে পারে। পিআইবি যেখানে বলা হয়েছে, যারা প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়া বা বার্তা সংস্থার কাজে সার্বক্ষণিক সাংবাদিক হিসেবে নিয়োজিত আছেন অথবা সেসব মিডিয়া বা সংস্থায় সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, উপ-সম্পাদক, সহকারী সম্পাদক, ফিচার লেখক, রিপোর্টার, সংবাদদাতা, কপিরাইটার, কার্টুনিস্ট, সংবাদ চিত্রগ্রাহক অথবা সম্পাদনা সহকারী হিসেবে কাজ করছেন এবং সরকারি প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত পদধারীরাও এই সংজ্ঞার অন্তর্ভূক্ত হবেন। ১৯৭৬ সালের ১৮ আগস্টের একটি সরকারি আদেশ (রেজুলেশন) দিয়ে এতদিন পিআইবির কার্যক্রম চলছিল। বাংলা একাডেমির অভিধান মতে, সাংবাদিক শব্দটির অর্থ দাঁড়ায়- সংবাদ সম্পর্কীয়, সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেন যিনি, সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য সংবাদ সংগ্রাহক। এছাড়াও সাংবাদিক শব্দটির সমার্থক হিসেবে আরো কিছু শব্দ পাওয়া গেছে। এগুলো হলো রিপোর্টার, প্রতিবেদক, সংবাদাতা, নিজস্ব সংবাদদাতা, বিশেষ সংবাদদাতা, জেলা সংবাদদাতা, জেলা প্রতিনিধি, স্টাফ রিপোর্টার, খবরদাতা, কলামিস্ট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উইকপিডিয়ার তথ্যমতে, সাংবাদিকতা হল বিভিন্ন ঘটনাবলী, বিষয়, ধারণা, ও মানুষ সম্পর্কিত প্রতিবেদন তৈরি ও পরিবেশন, যা উক্ত দিনের প্রধান সংবাদ এবং তা সমাজে প্রভাব বিস্তার করে। এই পেশায় শব্দটি দিয়ে তথ্য সংগ্রহের কৌশল ও সাহিত্যিক উপায় অবলম্বনকে বোঝায়। মুদ্রিত, টেলিভিশন, বেতার, ইন্টারনেট, এবং পূর্বে ব্যবহৃত নিউজরিল সংবাদ মাধ্যমের অন্তর্গত। বিভিন্ন স্থান, ক্ষেত্র, বিষয় ইত্যাদিকে ঘিরে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংবাদ সংগ্রহসহ বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহপূর্বক সংবাদ কিংবা প্রতিবেদন রচনা করে সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রেরণ করে থাকেন। পেশাজীবি হিসেবে একজন সাংবাদিকের কাজই হচ্ছে সাংবাদিকতায় সহায়তা করা। ক্যামব্রিজ ডিকশনারির ভাষায়, যে ব্যক্তি সংবাদপত্র বা ম্যাগাজিনের জন্য সংবাদ বা আর্টিকেল লিখেন অথবা রেডিও বা টেলিভিশনে এসব প্রচার করেন তিনিই সাংবাদিক। ড. পার্থ চট্রোপ্যাধায়ের মতে সাংবাদিকতার সংজ্ঞা, সাংবাদিকতা চলমান জীবনের বাক্যময় প্রতিচ্ছবি, যা কখনও মন্ময় কখনও বস্তুনিষ্ঠ। সাংবাদিকতা এই প্রতিচ্ছবিকে আপন হৃদয়ে গ্রহণ করে তাকে আবার সাধারণের কাছে ফিরিয়ে দেবার এক জটিল পদ্ধতি। সাংবাদিকতা বস্তুনিষ্ঠ সাহিত্য ও দ্রæতলয়ের ইতিহাসের সংমিশ্রণ। সাংবাদিকতা জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রের গতি-প্রকৃতি বর্ণনার এক প্রকৌশল। টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক Eric Hodgins এর ভাষায়, সাংবাদিকতা একটি দায়িত্বপূর্ণ কাজ, একটি মহৎ পেশাও বটে। মানুষের তথ্য জানার অধিকার এবং গণমাধ্যমের তথ্য জানানোর দায়বদ্ধতার প্রশ্নে সামাজিক অঙ্গীকার নিয়ে সাংবাদিকতা সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় প্রতিনিয়ত প্রহরী বা পর্যবেক্ষকের ভূমিকা প্রভাবিত হয়। সাংবাদিকতার প্রকারভেদ: ইনফোগ্রাফিক ১. ফটোসাংবাদিক: আলোকচিত্র তোলেন ২. ব্রডকাস্ট সাংবাদিক: টিভি, রেডিও, ইন্টারনেটে প্রচার সংক্রান্ত কাজ করেন ৩. অপরাধ সাংবাদিক: অপরাধবিষয়ক লেখা লেখেন ৪. কলামিস্ট: সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় বিশ্লেষণ করে প্রবন্ধ লেখেন ৫. ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক: স্বাধীনভাবে নিজের মতামত প্রকাশ করেন ৬. ক্রীড়া সাংবাদিক: খেলাধুলা সংক্রান্ত লেখা লেখেন ৭. নাগরিক সাংবাদিক: নাগরিক দায়িত্ববোধ থেকে নাগরিক সমস্যা নিয়ে লিখে থাকেন ৮. বিনোদন সাংবাদিক: বিনোধনধর্মী বিষয় যেমন তারকাদের জীবন, স্ক্যান্ডাল, রাশিফল এসব নিয়ে লিখে থাকেন ৯. ব্যাকপ্যাক সাংবাদিক: তিনি নিজেই রিপোর্টার, ভিডিওগ্রাফার, আলোকচিত্রী এবং প্রযোজক সাংবাদিকতার ধরন বিভিন্ন ধরনের পাঠকের জন্য সাংবাদিকতার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। একটি একক প্রকাশনায় (যেমন সংবাদপত্র) বিভিন্ন ধরনের সাংবাদিকতা উপাদান থাকে এবং প্রত্যেক উপাদান বিভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয়। সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন বা ওয়েবসাইটের প্রত্যেকটি বিভাগ ভিন্ন ভিন্ন পাঠকের জন্য সংবাদ সরবরাহ করে থাকে। সাংবাদিকতার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ধরন হলঃ ১. ওকালতি সাংবাদিকতা- কোন নির্দিষ্ট মতাদর্শ বা পাঠকের মতামতের প্রভাব সমর্থন করে লেখা হয়। ২. সম্প্রচার সাংবাদিকতা- বেতার বা টেলিভিশনের জন্য লিখিত সাংবাদিকতা। ৩. নাগরিক সাংবাদিকতা- নাগরিকদের অংশগ্রহণমূলক সাংবাদিকতা। ৪. উপাত্ত সাংবাদিকতা- ঘটনাবলী সংখ্যায় খুঁজে বের করার এবং তা সংখ্যায় প্রকাশ করার রীতি। ৫. ড্রোন সাংবাদিকতা- ড্রোন ব্যবহার করে বিভিন্ন ফুটেজ সংগ্রহ করা। ৬. গঞ্জো সাংবাদিকতা- হান্টার এস থম্পসন কর্তৃক উদ্ভাবিত গঞ্জো সাংবাদিকতা হল প্রতিবেদন প্রণয়নের নিজস্ব উপায়। ৭. পারস্পারিক ক্রিয়াশীল সাংবাদিকতা- অনলাইন সাংবাদিকতার একটি ধরন যা ওয়েবে উপস্থাপন করা হয়। ৮. অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা- সামাজিক সমস্যাসমূহ উদঘাটন করে এমন প্রতিবেদন। ৯. আলোকচিত্র সাংবাদিকতা- চিত্রের সাহায্যে সত্য ঘটনাসমূহ উপস্থাপনের রীতি। ১০. সেন্সর সাংবাদিকতা- অনুসন্ধানের লক্ষ্যে সেন্সর ব্যবহার করা। ১১. টেবলয়েড সাংবাদিকতা- বিনোদনমূলক সংবাদ প্রণয়ন, যা মূলধারার সাংবাদিকতা থেকে কম বৈধ। ১২. হলুদ সাংবাদিকতা- অতিরঞ্জিত অভিযোগ বা গুজব বিষয়ক প্রতিবেদন। ১৩. ক্রীড়া সাংবাদিকতা ক্রীড়া সাংবাদিকতা অপেশাদার এবং পেশাদার ক্রীড়া খবর এবং ঘটনা রিপোর্ট উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। ক্রীড়া সাংবাদিক সকল প্রিন্ট, টেলিভিশন সম্প্রচার এবং ইন্টারনেট সহ মিডিয়াতে কাজ করে। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমের বিকাশের ফলে সাংবাদিকতাকে একটি প্রক্রিয়া না বলে নির্দিষ্ট সংবাদ পণ্য বলে অভিহিত করার বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করা হচ্ছে। এই বিবেচনায়, সাংবাদিকতা হল এক ধরনের অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া যেখানে একাধিক লেখক ও সাংবাদিক এবং সামাজিকভাবে মধ্যস্থতাকারী জনগণ জড়িত থাকে। সাংবাদিকতা একটি বহুমাত্রিক সামাজিক দায়িত্বশীল পেশা। তথ্যায়ন ও বিশ্বায়নের বর্তমান যুগে মানব সম্পদ উন্নয়নের অন্যতম মৌলিক কৌশল বা উপায় হলো তথ্যায়ন ও ধারণায়ন। সমাজের এই গুরু দায়িত্বটি সুচারু রূপে যারা পালন করে থাকে তাকে সাংবাদিক বলে। সাংবাদিকতার জগৎটি এখন বিশাল ও বিস্তৃত। মানুষের তথ্য জানার অধিকার এবং গণমাধ্যমের তথ্য জানানোর দায়বদ্ধতার প্রশ্নে সামাজিক অঙ্গীকার নিয়ে সাংবাদিকতা সমাজ রাষ্ট্র এমনকি মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রায় প্রতিনিয়ত প্রহরী বা পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সাংবাদিকতাকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে মূল্যায়ন করা হয়। গুরুত্বের বিচারে রাষ্ট্রের আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের পরেই সংবাদ ক্ষেত্রের স্থান হলেও প্রথমোক্ত তিনটি স্তম্ভ এই চতুর্থ স্তম্ভ ছাড়া বর্তমান যুগে বহুলাংশে অকার্যকর ও অসম্পূর্ণ। এ সম্মানটুকু বজায় রাখার দায়িত্বও সাংবাদিকদের। সমাজের প্রতি মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে এই মহান পেশাতে নিয়োজিত থেকে নীতিবোধ ও নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে এ পেশাকে কলংকিত করা সাংবাদিকের কর্তব্য নয়। এ পেশায় স্বাধীনতা থাকতে পারে, কিন্তু স্বেচ্ছাচারিতা থাকা বাঞ্চনিয় নয়। স্বেচ্ছাচারিতা মনের মাধুরী মিশিয়ে গল্প তৈরি করা সাংবাদিকতার নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না, সংবাদের প্রয়োজনে ঘটনা তৈরি করা সাংবাদিকতা নয়। মনে রাকতে হবে সংবাদের প্রয়োজনে ঘটনা সৃষ্টি হয় না, সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলিই সংবাদ হিসাবে প্রকাশিত হয়। কুকুর মানুষকে কামড়ালে সেটা সংবাদ হয় না, কিন্তু মানুষ কুকুরকে কামড়ালে সেটা সংবাদ হিসাবে পরিবেশন করা যায়। একজন আদর্শ সাংবাদিকের রাগ অনুরাগ, বিরাগ বা আবেগ থাকতে নেই। এসব কিছুর উর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হবে। তাই প্রকৃত সাংবাদিকের কোন বন্ধু থাকে না। তথ্য প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি ও উৎকর্ষের সুবাদে একুশ শতকে এসে দ্রæতই বদলে যাচ্ছে মানব সব্যতার দৃশ্যপট। নতুন সহ¯্রাব্দের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও প্রচলিত ধারণা ও কৌশল গুলো এসেছে নানা পরিবর্তন। বিগত শতকের সংবাদপত্রের কার্যক্রম চিল কাগজ, কলম, নোটবুক আর ম্যানুয়াল ক্যামেরা নির্ভর। একুশ শতকে এসে তথ্য প্রযুক্তির সুবাধে ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ডিজিটাল ক্যামেরা, এমনকি মোবাইল ফোন ও মাল্টিমিডিয়া নির্ভর যন্ত্র কৌশল এর মাধ্যমে মূহুর্তেই সংবাদগুলো পৌছে যাচ্ছে প্রতিটি হাতের তালুতে। গোপন তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরবরহ করা সাংবাদিকতার মূল কাজ। জ্ঞানের পরিধি বিস্তারে তথ্য প্রধান উপকরণ হিসাবে কাজ করছে। জীবন জীবিকায় প্রয়োজনে জ্ঞানের ক্রমবিকাশ ঘটছে। সুচারুরূপে সরকার পরিচালনা তথা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তথ্যের অবাধ আদান-প্রদান গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসাবে কাজ করছে। তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে সম্প্রতিকালে এই তথ্য প্রবাহে নতুন গতি এসেছে, যাহা সাংবাদিকদের মাধ্যমে। “সাংবাদিকতা যেমন ঝুঁকিপূর্ণ পেশা, তেমনি দিগন্ত জয়ের দূরন্ত নেশার স্পর্ধিত তারুণ্যের দুঃসাহসী অভিযান সাংবাদিকতা”। নিজু ভাই সাংবাদিক যে কেউ একজন চলমান মানুষ তবে তার বুদ্ধি বিবেক সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান এবং পান্ডিত্য থাকতে হবে। তাকে থাকতে হবে সৎ সর্বাগ্রে, থাকতে হবে দেশপ্রেম। অগাধ জ্ঞান এবং পান্ডিত্য শব্দ দুটো সাংবাদিকতায় বেশির ভাগ ঘেরে আসে না। তবে যিনি সাংবাদিকদের শিক্ষক হবেন তাকে এ সম্বন্ধীয় জ্ঞান থাকতে হবে। এখানে সাংবাদিকদের উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসে সাংবাদিকতায় যোগ দিতে হবে এমন কোন কথা নেই, তবে সাংবাদিকতায় থাকতে হবে নবনব কৌশলের আবিস্কার এবং ইংরেজীতে দক্ষসহ খুব দ্রæত মস্তিষ্কের মিথস্ক্রিয়া। সংবাদ তৈরি বা লেখনীতে থাকতে হবে খুব সহজ ভাষার প্রয়োগ যা বাংলা অথবা ইংরেজী উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য কারণ সার্বক্ষণিক মাথায় রাখতে হবে; আমি যা লিখছি তা নিরক্ষর ব্যক্তি থেকে সর্বোচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিটি পর্যন্ত খুব তরল ভাষায় বুকে উঠতে সক্ষম হোন। অতএব যিনি সাংবাদিক হবার ইচ্ছে পোষণ করবে তাকে প্রথমত: বাংলা এবং ইংরেজি ভাষা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত: দ্রæত লেখনিতে অভ্যস্ত হতে হবে। তৃতীয়ত: অত্যন্ত সাদা-মাটা, সহজ-সরল ভাষা সম্পর্কে দক্ষ হতে হবে। আরো একটা বিষয় সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হতে হবে যা হলো: সাংবাদিকের সংবাদ লেখনীতে নিজস্ব একটি স্টাইল সৃষ্টি করতে হবে এবং স্টাইল যদি তৈরি করতে পারেন, নিশ্চিত বাবে বলা যায় তিনি তরতর করে শীর্ষে উঠে যেতে পারবেন। কথা হলো স্টাইল টা কি এবং কেমন করে সেটা সৃষ্টি করা সম্ভব। সংবাদ লেখনীতে স্টাইল সৃষ্টি করা অবাক করার কথা বটে। কিন্তু এটা সম্ভব কি করে? খুবই সহজ- আমরা যখন খুব বেশি বাংলা সিনেমা দেখতাম এবং দেখতে দেখতেই তৃতীয় নয়নে ধাক্কা খেতো। এক পর্যায়ে সিনেমার মাঝপথে যখন হাজির হতাম তখন এক নজরেই বলে দিতাম এটা চাষী নজরুলের ছবি কিংবা এটা আলমগীর কবির কিংবা সুভাষ দত্তের ছবি অথবা আমজাদ হোসেনের ছবি। এর কারণ কি? উত্তর খুবই সোজা- চলচিত্র বা সিনেমার ফ্রেম যা নিজস্ব স্টাইলে পরিণত হয়েছে। এবং পরিচালক নিজের মেধা ও যোগ্যতায় সৃষ্টি করতে পেরেছেন। সাংবাদিকতায়ও একটা নিজস্ব তৃতীয় নয়ন রয়েছে স্টাইল। টেবিল টেনিস খেলার পিংপং বল সবাই চেনেন। এই বলটা মাটিতে পড়ে গেলে দীর্ঘক্ষণ লাফাতে থাকে এবং যতক্ষণ লাফাতে থাকে ততক্ষণ হলো সাংবাদিকতা। কেউ যদি বুদ্ধিমান হোন এর মাঝেই তিনি সৃষ্টি করতে পারবেন নিজস্ব স্টাইল এবং এখান থেকেই উৎপত্তি হয় আধ্যাত্বিকতা। কেউ যদি আমাকে বলেন সাংবাদিকতায় আধ্যাত্বিকতা নেই তাহলে আমি সেটা বিশ্বাস করবো না। কারণ, সাংবাদিকতায় সিরিয়াস লেখাগুলো আমি আমি মাঝ রাতেই লিখতে পেরেছি যা আমার জন্য স্টাইলের সৃষ্টি করেছে। যা অনেকটা সংবাদ রচনার জন্য একেকরকম ফ্রেম। সাংবাদিক কি- এটা বরার আগে আমি কেন অন্তরা থেকে শুরু করলাম এটা জানার আগ্রহ থাকাটা স্বাভাবিক। সাংবাদিক কি এটা প্রারম্ভিকে না আনার কারণ, আমার উপলদ্ধি বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলে জুড়েই রয়েছে নানাবিধ সংবাদের ভান্ডার। ঘর থেকে বের হলেই জড়িয়ে পড়ে পায়ে পায়ে সংবাদ। নানা রকমের মানুস নানা রকম কিছু না কিছু একটা করছে। কেউ পজেটিভ কেউ নেগেটিভ। সুতরাং কার না সাধ জাগে এগুলো নিয়ে কিচু একটা লিখি এবং কেউ যকন রিখলো এবং লেখাটা কাগজে প্রকাশ পেলো তখন কিন্তু সে সাংবাদিক হলেন না। তিনি সাংবাদিক হলেন তখন, যখন তিনি তার লেখাগুলো একটি দায়িত্বশীল পেশায় রূপানতরিত করলেন এবং তার সংবাদগুলো মার্জিত হলো, পাঠক মজা পেলো, দূর্ভাগ্যে পড়া মানুষগুলো তার কাছে আসতে লাগলো, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন তার প্রতি আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হলেন- তার সংবাদ লেখনী এবং প্রকাশ ভঙ্গির হাতে খড়ির সূচনা সৃষ্টি হলো। তাহলে প্রারম্ভিকতায় পাওয়া গেল- বুদ্ধি বিবেক, জ্ঞান পান্ডিত্য, সততা, দেশ প্রেম, দক্ষতা, মস্তিস্কের মিথস্ক্রিয়া, তরল ভাষা, বাংলা, ইংরেজীর দক্ষতা আনয়ন, দ্রæত লেখনিতে অভ্যস্ত, স্টাইল সৃষ্টি, আধ্যাত্বিকতা, প্রেম। বলা বাহুল্য একজন সাংবাদিককে লেখালেখিতে সিদ্ধহস্ত হতে হবে। প্রমিত বাংলা ভাষার জ্ঞান তার দখলে থাকতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে সাংবাদিকতায় লেখনীর প্রতিটি শব্দ হতে হবে অত্যন্ত সাধারণ। গ্রাম বাংলার আটপৌড়ে নারীর জীবনের মতো। সাংবাদিকতা গল্প কিন্তু গল্প নয় রচনা কিন্তু রচনা নয় এবং কাল্পনিক তো নয়ই।

Notice

Visitors

  • Total Visitors : 18004
  • Today's Visitors : 18
  • Online : 1